## দ্বীন ও মাযহাব

মাওলানা মুহাম্মদ আমীন সফদর রহ.
মহান আল্লাহ পাকের নিকট সত্য গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম, যে ব্যক্তি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোন ধর্মকে দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করবে, সে ধর্ম আল্লাহ পাকের নিকট কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে আল্লাহ পাকের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হল-
شَرَعَ لَكُمْ مِّنَ الدِّیْنِ مَا وَصّٰی بِهٖ نُوْحًا وَّ الَّذِیْۤ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْکَ وَمَا وَصَّیْنَا بِهٖۤ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰی وَ عِیْسٰۤی اَنْ اَقِیْمُوا الدِّیْنَ وَ لَا تَتَفَرَّقُوْا فِیْهِ کَبُرَ عَلَی الْمُشْرِکِیْنَ مَا تَدْعُوْهُمْ اِلَیْهِ ؕ اَللهُ یَجْتَبِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یَّشَآءُ وَ یَهْدِیْۤ اِلَیْهِ مَنْ یُّنِیْبُ ﴿ ﴾ وَ مَا تَفَرَّقُوْۤا اِلَّا مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْیًۢا بَیْنَهُمْ
অর্থ: দ্বীনের ক্ষেত্রে ঐ পথ ও পন্থাই তিনি তোমাদের জন্য স্থির করেছেন যা পালন করতে হুকুম করেছিলেন নূহকে আর যা (পালন করতে) আমি আদেশ করেছিলাম ইবরাহীমকে, মূসাকে এবং ঈসাকে এই মর্মে যে, দ্বীনকে কায়েম ও প্রতি
ষ্ঠিত রাখ এবং তাতে ইখতেলাক ও মতবিরোধ বাধিয়ো না। আল্লাহ পাক নির্বাচন করেন যাকে ইচ্ছা করেন। আর তার প্রতি পথ প্রদর্শন করেন যে তার অভিমুখী হয়। আর জানা-বোঝার পর যারা ইখতেলাফ ও মতবিরোধ বাধিয়েছে তারা (মূলত) জেদ ও হঠকারিতা বশত (মতবিরোধ বাধিয়েছে)।
উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, মূল ও আসল দ্বীন সর্বদা এক ও অভিন্ন ছিল। কারণ আকাঈদ ও বিশ্বাস, আখলাক ও উন্নত স্বভাব চরিত্র এবং দ্বীনি মূলনীতির ক্ষেত্রে সমস্ত নবী আ. এক ও অভিন্ন নীতিমালা অনুসরণ করেছেন। দ্বীনী আকাঈদ ও ধর্মবিশ্বাসে মতবিরোধ বরদাশতযোগ্য নয়। যারা দ্বীনী বিষয়ে ইখতেলাফ ও মতবিরোধ করে তাদের নিকট কোন ইলমী তথা একাডেমিক কোন ভিত্তি ও বুনিয়াদ নেই, আছে কেবল নিছক জেদ, হঠকারিতা ও একগুয়েমি যা এক দুরারোগ্য ব্যাধি।
বিভিন্ন নবীদের শরীয়ত তথা ব্যবহারিক বিধানের ক্ষেত্রে বৈচিত্র ও ভিন্নতা
দ্বীনী আকীদা বিশ্বাসে এক থাকা সত্ত্বেও নবীগণের শরীয়ত ও ব্যবহারিক বিধানসমূহে হালাল হারাম এবং বৈধ-অবৈধের ইখতেলাফ ও ভিন্নতা ছিল-
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَۃً وَّمِنْهَاجًا
অর্থ, তোমাদের মধ্য থেকে প্রত্যেককে আমি একটি সংবিধান ও জীবনবিধান দান করেছি। সূরা মায়েদা : ৪৮
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক উম্মতের আইন-কানূন, বিচারব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা ঐ উম্মতের স্বভাব, যোগ্যতা, পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পারিপাশির্^কতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন স্থির করেছেন। ব্যবহারিক বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে ভিন্নতা সত্ত্বেও সমস্ত নবী আলাইহিমুস সালাম এবং সকল আসমানী দ্বীনের মূলনীতি ও মৌলিক লক্ষ্য উদ্দেশ্যের -যার উপর পরকালীন মুক্তি ও নাজাত নির্ভরশীল- ক্ষেত্রে পুরোপুরি এক ও অভিন্ন। একটি অপরটিকে সত্যায়নকারী তথাপি অমৌলিক ও শাখাগত বিধানের ক্ষেত্রে প্রতিটি উম্মতকে তাদের স্থান-কাল-পাত্র ও পরিবেশ পরিস্থিতি পারিপাশির্^কতা বিবেচনায় তাদের বিশেষ গুণ, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। উক্ত আয়াতে সেই শাখাগত বিধানের বৈচিত্র ও ভিন্নতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
বোখারী শরীফের একটি হাদীসে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত নবী আ.কে এমন সহোদর ভাই আখ্যায়িত করেছেন যাদের পিতা এক ও অভিন্ন কিন্তু মা ভিন্ন ভিন্ন। এই হাদীসের মূলমর্ম এটিই যে, মূল ও গোড়া সকলের এক ও অভিন্ন শাখাগত বিষয়ে কিছু কিছু ভিন্নতা ও বৈচিত্র রয়েছে। আর সন্তান জন্মদানে পিতা হলেন মূল উৎস ও ঝরণাধারা আর মা তার ধারণপাত্র ও সংরক্ষকমাত্র। তো প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য দ্বারা এদিকেও সূ² ইঙ্গিত পাওয়া গেল যে, আসমানী শরীয়তের ইখতেলাফ ও বিভিন্নতার ভিত্তি হল মুখাতাব ও সম্বোধিতগণের যোগ্যতা ও উপযুক্ততার। নতুবা মূল উৎস ও দাতার মধ্যে কোন দ্বিত্ব ও ভিন্নতা নেই। সকল আসমানী শরীয়ত ও জীবনব্যবস্থার উৎসমূল একমাত্র মহান এক সত্তা। তার জ্ঞান চিরন্তন। সুতরাং আসমানী শরীয়তের ইখতেলাফ ও বিভিন্নতা দেখে অহেতুক আলোচনা ও সমালোচনায় সময় নষ্ট না করা উচিত। আল্লাহপ্রেমী পরকালের পথিকদের পরকালের পাথেয় সঞ্চয় ও আমলে নিমগ্ন থাকা উচিৎ।
আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে একতা ও অভিন্নতা সত্ত্বেও নবীদের শরীয়ত ও ব্যবহারিক জীবনবিধানের ক্ষেত্রে ভিন্নতা ও বৈচিত্র ছিল। কোন শরীয়তে সম্মানসূচক সেজদা বৈধ ছিল আবার কোন শরীয়তে হারাম ও অবৈধ। কোন শরীয়তে একই সঙ্গে দু’বোনকে বিবাহ করা বৈধ আবার কোনটায় অবৈধ। তবে হালাল হারামের এই ব্যবধান সত্ত্বেও প্রতিটি শরীয়ত আপন আপন যুগে সর্বাঙ্গীন সত্য, সঠিক ও যথার্থ
ছিল। পরবর্তীযুগে পূর্ববর্তীকালের কোন ‘বিধান’ রহিত আখ্যায়িত হলে, তার উপর ‘আমল’ বন্ধ ও স্থগিত হয়ে যেত। নতুন বিধানের উপর আমল চালু হত।
বড় মারাত্মক পদস্খলন
আল্লামা আব্দুল ওয়াহহাব শারানী (মৃ: ৯১২হি.) বলেন- ‘দ্বীনের শাখাগত বিষয়গুলোকে উসূল ও মূলনীতির সমতুল্য বিবেচনা করা যাবে না, যাতে কেউ এই যুক্তি দেখাতে না পারে যে, উসূল ও মূলনীতির মধ্যে যেমন ভিন্নমত পোষণ নাজায়েয তদ্রূপ শাখাগত বিষয়ের ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ নাজায়েয। কারণ এ ধরনের যুক্তি ও কিয়াস মারাত্মক পদস্খলন। মীযানে কুবরা ১/৬৬
বর্তমান যুগের আহলে হদীস তথা গায়রে মুকাল্লিদগণও এই যুক্তিকে আঁকড়ে ধরে আছে যা সম্পূর্ণ কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী। তারা এই বলে হৈচৈ করে যে, আকায়েদের ক্ষেত্রে চার ইমাম একমত হওয়া সত্ত্বেও ফুরু ও শাখাগত মাসআলার ক্ষেত্রে ভিন্ন ও পৃথক কেন? মাসআলাগত বিষয়ে তাদের ইখতেলাফ ও মতবিরোধকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে তাদের মাযহাবকে ভুল ও ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে থাকে। যদি বিষয়টি এমনই হয়ে থাকে তাহলে কি নবী আ.দের শরীয়তসমূহে হালাল হারামের ব্যবধান ও ভিন্নতার কারণে তাদের সকলের শরীয়তকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করা হবে?
ইখতেলাফ ও মতবিরোধের শ্রেণি ও প্রকার
ইখতেলাফ ও মতবিরোধ বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে-
এক. দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে ইখতেলাফ ও মতবিরোধ :
সমস্ত জরুরীয়াতে দ্বীন তথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত দ্বীনী বিষয়সমূহকে মানার নাম ঈমান। আর জরুরীয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত কোন একটি বিধানকে অস্বীকার করা কিংবা অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা করা কুফুরী। উদাহরণত, খতমে নবুয়তের আকীদা জরুরীয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। এখন যদি কেউ একথা উচ্চারণ করে- আমি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে خاتم النبيين বা শেষ নবী মানি না তাহলে সে কাফের। কিংবা কেউ একথা বলে যে আমি তাকে خاتم النبيين বা শেষ নবী মানি তবে خاتم النبيين অর্থ নবী গড়ার কারিগর অর্থাৎ তিনি মহর মেরে মেরে নতুন নতুন নবী তৈরী করতেন তাহলে সেও কাফের। কারণ خاتم النبيين শব্দসম্বলিত আয়াত যেমন তাওয়াতুর ও পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে সুপ্রমাণিত তদ্রূপ তার অর্থ ও মূলমর্মও অর্থ্যাৎ ‘তার পরে আর কোন নতুন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না’ তাওয়াতুর ও পূর্ণ নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে সুপ্রমানিত। এই ইখতেলাফ ও মতবিরোধকে ইসলাম ও কুফুরের ইখতেলাফ ও মতবিরোধ বলে।
দুই. ইসলামের গণ্ডিভুক্তদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তন্মধ্যে ৭২টি জাহান্নামী হবে আর একদল জান্নাতী হবে। একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন- সেই জান্নাতীদল কোনটি?
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ما أنا عليه وأصحابي অর্থাৎ তারা হল ঐ দল যাদের তরীকা আমার সুন্নত মুতাবেক এবং আমার সাহাবাদের সীরাত ও চরিত মুতাবেক অর্থ্যাৎ ঐ দলটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত। মেশকাত
অর্থাৎ এসব দল দ্বীনে মুহাম্মদীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে মুহাম্মদী কিন্তু মুক্তিলাভকারী কেবল সুন্নী মুহাম্মদী।
মুহাম্মদী হওয়ার মানদণ্ড ও মাপকাঠি
ভারত উপমহাদেশে গায়রে মুকাল্লিদদের প্রথম সারির সর্বজনমান্য আলেম জনাব ছানাউল্লাহ অমৃতসরীর ‘মুহাম্মদিয়্যাত’ এর মাপকাঠিতে তো কাদিয়ানীরাও অন্তর্ভুক্ত! তিনি লিখেন-‘ইসলামী দল উপদলগুলোর মধ্যে যতই ইখতেলাফ ও মতবিরোধ থাকুক না কেন চূড়ান্ত বিচারে তারা মুহাম্মদিয়্যাত এর যে মাপকাঠি তথা والذين معه ‘আর যারা তাঁর (নবীজীর) সঙ্গে’ এর অন্তর্ভুক্ত, তাই তাদের মধ্যে যদিও চরম বিরোধ ও বৈরিতা রয়েছে তবুও মুহাম্মদিয়্যাতের এই মানদণ্ডের নিরীখে তাদের পরস্পরে رحماء بينهم নিজেদের মধ্যে সহমর্মী ও রহমদিল হওয়া উচিৎ। আমি কাদিয়ানীদের ঘোরবিরোধী কিন্তু তবুও আমি তাদেরকে মুহাম্মদিয়্যাতের গণ্ডিভুক্ত মনে করি।’ আখবারে আহলে হাদীস, অমৃতসর ১৬ই এপ্রিল ১৯১৫ খ্রিঃ।
উল্লেখিত উদ্ধৃতিটি গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর মৃত্যুর সাত বছর পরের। উক্ত উদ্ধৃতিটির পাশাপাশি একথাও স্মরণযোগ্য যে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম আহলে হাদীস দাবীদার ছিলেন হাফেজ মুহাম্মদ ইউসুফ, তার ব্যাপারে এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ‘অমৃতসরের সর্বপ্রথম আহলে হাদীস দাবিদার অবসর প্রাপ্ত ডেপুটি কালেক্টর হাফেজ মুহাম্মদ ইউসুফ গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর সমর্থক ও সহযোগীতে পরিণত হয়েছে।’ ইশাআতুস সুন্নাহ ২১/১১৪
অবশেষে চূড়ান্ত বিচারে গায়রে মুকাল্লিদ হওয়াটা হাদীস অস্বীকার ও কাদিয়ানী হওয়ার প্রথম ধাপ বলে প্রমাণিত ও সাব্যস্ত হল।
এই দ্বিতীয় প্রকারের ইখতেলাফ ও মতবিরোধকে সুন্নত ও বেদাতের ইখতেলাফ ও মতবিরোধ বলে গণ্য।
তৃতীয় প্রকারের ইখতেলাফ ও মতবিরোধ হল- ইজতেহাদী ইখতেলাফ ও মতবিরোধ। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে আকাঈদের ক্ষেত্রে ঐক্য থাকা সত্ত্বেও ইজতেহাদী মাসআলা মাসায়েলে হালাল হারামের পর্যন্ত ইখতেলাফ ছিল। যেমন মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়াবা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এবং তাহাবী শরীফের মত কিতাবসমূহ অধ্যয়নের দ্বারা দিবালোকের মত সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। এসব অস্বীকার করা মানে দিবসের মধ্যগগনের সূর্যকে অস্বীকার করা। আর এ ধরনের ইখতেলাফ ও মতবিরোধ তাবেঈন তাবে তাবেঈনদের মধ্যেও ছিল। হাদীসের কিতাবসূমহে মুজতাহিদ সাহাবা, তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈনের সময়ের ফতোয়া সঙ্কলিত হয়েছে। তাতে না কোন মুফতী আপন ফতোয়ার স্বপক্ষে কোন আয়াত অথবা হাদীস দলীলস্বরূপ পেশ করেছেন আর না কোন ফতোয়াজিজ্ঞাসু একথা বলেছেন- কোরআন হাদীসের দলীল প্রমাণ ছাড়া
ফতোয়া মানব না। সাহাবা তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনগণের ফতোয়ার মধ্যে যেমন শুধু মাসআলার উল্লেখ থাকত কোন আয়াত কিংবা হাদীস দলীল হিসেবে উল্লেখ থাকত না তদ্রূপ কল্যাণ শতাব্দীত্রয়ের মত আমাদের ফতোয়ায়ও নেই। (তাতে কেবল মাসআলা উল্লেখ থাকে, দলীল প্রমাণ উল্লেখ থাকে না। ফাতাওয়া বাযযাযিয়া, ফাতাওয়া কাজী খান ও ফাতাওয়া আলমগীরী ইত্যাদি ফাতাওয়ার কিতাবগুলোতে নিছক মাসআলা মাসায়েল উল্লেখ থাকে। দলীল প্রমাণ উল্লেখ থাকে না।) গায়রে মুকাল্লিদগণ খায়রুল কুরুন তথা কল্যাণ শতাব্দীত্রয়ের এই তরীকা ও পদ্ধতিকে ভ্রান্ত আখ্যায়িত করে।
বর্তমানে গায়রে মুকাল্লিদদেরকে দলীল প্রমাণ উল্লেখ করা ছাড়া ফতোয়া দিলে তারা সেই ফতোয়া একেবারেই মানতে চায় না। কিন্তু কল্যাণশতাব্দীত্রয়ে একজন গায়রে মুকাল্লিদও ছিল না যে এ ধরনের ফতোয়া মানতে অস্বীকার করেছে। এমনকি বিগত কয়েক শতাব্দী পূর্বে যখন ফাতাওয়া আলমগীরী সঙ্কলিত হয়েছে তখন আরব অনারবের সকল ফতোয়া বিভাগ তাকে মহামূল্যবান রতœ হিসেবে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। কেউ তার (ফাতাওয়া আলমগীরীর) বিরুদ্ধে কিংবা ফাতাওয়া কাজী খানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেনি। কারণ সে যুগ পর্যন্ত ভূপৃষ্ঠ গায়রে মুকাল্লিদের ছায়া থেকে পবিত্র ছিল। গায়রে মুকাল্লিদদের মধ্যে সাহস গায়রত ও আত্মমর্যাদার ছিটেফোঁটাও থেকে থাকলে তারা যেন সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কেরামের ঐ সব ফাতোয়ার রদ লিখুক যেগুলো দলীল প্রমাণ ছাড়া হাদীসের কিতাবাদিতে সঙ্কলিত হয়েছে। তারপর তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনদের ফতোয়াসমূহের রদ লিখুক পাশাপাশি এই প্রশ্নের সমাধানও পেশ করুক- অন্যান্য ছাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনগণ কেন এসব ফতোয়ার রদ লিখেননি? আর গায়রে মুকাল্লিদরা কেন কল্যাণশতাব্দীত্রয়ের ঐ তরিকা ও পদ্ধতি থেকে দূরে সরে এল?
এটি এমন একটি ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও প্রমাণ যা রদ ও খণ্ডনের একেবারে ঊর্ধ্বে যে, ফাতাওয়া আলমগীরী সঙ্কলন পর্যন্ত কল্যাণশতাব্দীত্রয়ে স্বীকৃত রীতিই প্রচলিত ছিল। গায়রে মুকাল্লিদদের ফতোয়াসমূহের মধ্যে প্রশ্ন উত্তরের যে রীতি ও পদ্ধতি সূচিত ও প্রবর্তিত হয়েছে তা দ্বাদশ শতাব্দী পরবর্তী বেদআত।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- الآيات بعد المأتين কিয়ামতের আলামত দুই শতাব্দী পর থেকে প্রকাশ পেতে শুরু করবে। মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেন- ‘দুই শতাব্দী পর’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল এক হাজার বছর পরবর্তী দুই শতাব্দী। আর গায়রে মুকাল্লিদ ফেরকা এক হাজার বছর পরবর্তী দুই শতাব্দী পর আবির্ভূত হয়েছে। সুতরাং এই দলটির আবির্ভাব কিয়ামতের আলামতসমূহের একটি।
সারকথা হল- আমি তিন ধরনের ইখতিলাফ ও মতবিরোধের কথা আলোচনা করেছি।
এক. কুফর ও ইসলামের মতবিরোধ- ইসলাম ঐসব সুমহান আকীদা-বিশ্বাসের নাম যা জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত, এসব নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন মুসলমান মতবিরোধ করেনি। এ ধরনের জরুরী ও অকাট্য আকীদা-বিশ্বাসগুলোর ক্ষেত্রে সকলেই একমত। আজকাল যে মূর্খরা বলে বেড়ায়- চার ইমাম এক দ্বীনকে চার টুকরো করে ফেলেছে এটা বিশ্বজগতের সবচেয়ে জঘন্য মিথ্যা রটনা। জরুরিয়াতে দ্বীন ও দ্বীনের অকাট্য বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সকল ইমাম একমত। দ্বীনে ইসলাম অর্থাৎ জরুরিয়াতে দ্বীন পূর্বেও এক ও অভিন্ন ছিল এবং আজও সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন আছে। আর কিয়ামত পর্যন্ত পুরোপুরি এক ও অভিন্ন থাকবে।
এ ধরনের কথাবার্তা ঐ জাহেলে মুরাক্কাব বা অল্প বিদ্যার অধিকারী ভয়ঙ্কর গোছের ব্যক্তিরাই কেবল বলতে পারে যারা না দ্বীনের অর্থ বোঝে আর না ইসলামের অর্থ বোঝে। দ্বীনে ইসলাম তো হযরত আদম আ. থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত একই আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত একই থাকবে। এক্ষেত্রে খণ্ডিত ও বিভক্ত হতেই পারে না। কারণ জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে গণ্য একটি বিষয়কে অস্বীকার করা মাত্রই মানুষ দ্বীন থেকে বহিষ্কৃত বলে আখ্যায়িত হয়। এ ধারণাই সম্পূর্ণ ভুল যে, এক ব্যক্তি দ্বীনের একাংশ নিয়ে যাবে কিংবা গ্রহণ করে বসে থাকবে আবার সে মুসলমান বলে গণ্য হবে, আর অন্যজন আরেক অংশ নিয়ে যাবে আবার সেও মুসলমান বলে গণ্য হবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। কবির ভাষায়-
ایں خيال ست ومحال ست وجنون
এতো সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং কল্পনাবিলাস ছাড়া আর কিছুই না।
তাই যে খণ্ডবিখণ্ড ইসলামের ধারণা পোষণ করে তার উচিৎ আগে নিজের ইসলামের খোঁজ-খবর নেওয়া। বোঝা গেল মূর্খতা ও মূঢ়তার চূড়ান্ত ধাপের নাম হল গায়রে মুকাল্লিদী।
দ্বিতীয় প্রকারের ইখতেলাফ ও মতবিরোধ হল- ইসলামের গণ্ডিভুক্ত থেকে সুন্নত ও বেদআতের ইখতেলাফ। এখানে একটি দল হল আহলে সুন্নত যারা ‘আলজামাআ ও সাওয়াদে আ’জম’ তথা জামাত এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের জামাত বলে গণ্য। এছাড়া অবশিষ্ট বাহাত্তর ফেরকা ও দল-উপদলের ভবিষ্যদ্বাণী হাদীসে রয়েছে, সাহাবায়ে কেরামের তরীকা থেকে সরে যাওয়ার কারণে তাদেরকে ফেরকা বলা হয়।
শুধুমাত্র তারাই আহলে সুন্নত বলে গণ্য হবে যারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের স্বীকৃত জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্গত বিষয়গুলোকে অকপটে স্বীকার করবে। তন্মধ্যে একটিমাত্র বিষয়কে অস্বীকারকারীও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের গণ্ডিবহির্ভূত বলে আখ্যায়িত হবে এবং অন্যান্য ফেরকার শ্রেণীভুক্ত বলে গণ্য হবে। এতে বোঝা গেল, আহলে সুন্নত বলে গণ্য হওয়ার মূলনীতিতে কোন মতপার্থক্য নেই। কারণ কেউ যখন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের একটিমাত্র আকীদা-বিশ্বাসকেও অস্বীকার করবে সে আর আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতভুক্ত বলে গণ্য হবে না। উদাহরণত কেউ যদি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদায়ে তাকদীদের ভুল ব্যাখ্যা করে তাহলে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতভুক্ত বলে বিবেচিত হবে না; বরং কাদরিয়া ফেরকাভুক্ত বলে আখ্যায়িত হবে।
তদ্রূপ কেউ যদি আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত আকীদা ‘কবরের আযাব’ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা করে তাহলে সেও আহলে সুন্নতভুক্ত থাকবে না; বরং মু’তাযিলা ফেরকাভুক্ত বলে গণ্য হবে। তো আহলে সুন্নতভুক্ত বলে তিনিই গণ্য হবেন যিনি আহলে সুন্নত স্বীকৃত সমস্ত জরুরিয়াতে দ্বীনকে অকপটে স্বীকার করবেন। আজকাল আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে ব্যাখ্যা সম্বলিত নতুন নতুন কিতাবাদি প্রকাশিত হচ্ছে তন্মধ্যে মাপকাঠি ও মানদণ্ড পর্যায়ের কিতাব হল- المهند على المفند নামক গ্রন্থটি। গ্রন্থটি ‘আকায়েদে উলামায়ে দেওবন্দ’ নামে প্রসিদ্ধ। গ্রন্থটির শুরুতে তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরব অনারব অনেক উলামায়ে কেরামের সত্যায়ন ও স্বীকৃতি ছাপা হয়েছে। এক্ষেত্রে এ কথাও স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, এই আকীদা-বিশ্বাস ইসলামের সূচনালগ্নে থেকে অবিচ্ছিন্ন পরম্পরা ও নিরবচ্ছিন্ন সূত্রধারার মাধ্যমে বর্তমান যুগ পর্যন্ত সগৌরবে বিদ্যমান রয়েছে। কল্যাণশতাব্দীত্রয়ে কিছু সংখ্যক শীর্ষস্থানীয় আহলেসুন্নতমনীষী মুজতাহিদ ছিলেন। অবশিষ্টরা তাদের আনুসারী ও অনুগামী ছিল। খায়রুল কুরুন ও কল্যাণ শতাব্দীত্রয়ের নিঃশর্ত ইজাতেহাদের স্তর খতম হয়ে গেছে। বর্তমানে বিদ্যমান সকল আহলে সুন্নত মুকাল্লিদ। বর্তমানে আখেরী যামানায় কিয়ামত খুব নিকটবর্তী হওয়ায় দারুন কিছু সংখ্যক মানুষ তাকলীদ বর্জন করে আহলে সুন্নত (মুক্তিপ্রাপ্ত জামাত) থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। নফস ও প্রবৃত্তিদাস শ্রেণীর লোকদের আহলে সুন্নত থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে আহলে সুন্নতগণ এই মন্তব্য করছেন-
خس کم جہاں پاک
অপদার্থ কমলে ভাল মানুষ বাঁচতে পারে, দুনিয়া পবিত্র হয়।
তৃতীয় ইখতেলাফ ও মতবিরোধ হল- ইজতেহাদী যা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সীমারেখায় থেকে ইখতেলাফ করা। সাহাবা, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈনদের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও শাখাগত বিষয়ে মতবিরোধ ছিল।
আল্লামা যাহাবী রহ. লিখেন- ছাওবান রাযি. বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে হযরত উমর রাযি., হযরত আলী রাযি. হযরত মুআয রাযি. এবং হযরত আবু মুসা রাযি. এই চার মহান ব্যক্তি ছাড়া কেউ ফতোয়া প্রদান করতেন না। তাযকিরাতুল হুফফাজ উর্দূ : ৪৩
হযরত মাসরুক রহ. (মৃত্যু ৬২ হি.) বলেন- সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে উঁচু স্তরের মুফতী ছিলেন- হযরত উমর রাযি., হযরত আলী রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযি., হযরত যায়েদ বিন ছাবেত রাযি. এবং হযরত আবু মুসা আশআরী রাযি.। তাযকিরাতুল হুফফাজ উর্দূ সংস্করণ : ৪৮
তাদের সকলের ফতোয়া একে তো দলীল প্রমাণ উল্লেখ করা ছাড়া। দ্বিতীয়ত তাদের ফতোয়াসমূহের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। যেন সাহাবাদের আমল থেকেই কমপক্ষে পাঁচটি মতবিরোধপূর্ণ মাযহারের প্রচলন ছিল।
এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. লিখেন-
ثم إنهم تفرقوا في البلاد وصار كل واحد مقتدى ناحية من النواحي فكثرت الوقائع ودارت المسائل فاستفتوا فيها فأجاب كل واحد حسب ما حفظه أو استنبطه وإن لم يجد فيما حفظه أو استنبطه ما يصلح للجواب اجتهد برأيه
তারপর মুজতাহিদ সাহাবাগণ দেশে দেশে ছাড়িয়ে পড়েছেন। তন্মধ্যে প্রত্যেকে আপন আপন অঞ্চলে ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন (অর্থাৎ প্রত্যেক অঞ্চলের জনসাধারণ নিজেদের ইমামের তাকলীদ করতে শুরু করেন) জনসাধারণ বহু নিত্য নতুন মাসআলা মাসায়েলের মুখোমুখি হত এবং তার সমাধান পেতে প্রত্যেক অঞ্চলের জনসাধারণ আপন আপন অঞ্চলের ইমামদের শরণাপন্ন হত তখন তারা (ইমামগণ) স্মৃতিশক্তিতে সংরক্ষিত কিংবা উদ্ভাবিত মাসায়েলের আলোকে ফতোয়া প্রদান করতেন। যেসব মাসআলা সংরক্ষিত কিংবা উদ্ভাবিত কোন মাসআলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হত সেসব ক্ষেত্রে নিজ রায় ও ইজতেহাদের আলোকে সমাধান দিতেন। আল-ইনসাফ : ১/২
এভাবে শত শত মাযহাবের উদ্ভব ঘটে। তারপর তবেঈন এবং তাবে তাবেঈনদের যুগে এসে ইসলামের বিপুল বিস্তার ঘটে। এভাবে প্রত্যেক এলাকার ইমামের পৃথক পৃথক মাযহাব গড়ে উঠে এবং মাযহারের সংখ্যা হাজারের কোটা পেরিয়ে যায়।
চার মাযহাব
পূর্ব যুগের রীতি ছিল- মানুষ প্রত্যহ যে মাসআলারই সম্মুখীন হত তার সমাধান আপন এলাকার ইমাম সাহেবের কাছ থেকে জেনে নিত এবং সে অনুযায়ী আমল করত। আঞ্চলিক ও এলাকাভিত্তিক ইমামদের মাযহাব না ছিল পূর্ণাঙ্গ না ছিল সঙ্কলিত আর না ছিল মুতাওয়াতের অর্থাৎ পূর্ণ আস্থাযোগ্য অবিচ্ছিন্ন পরম্পরায় বর্ণিত। চার ইমাম সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয় সকল মাসআলা মাসায়েল সর্বসাধারণের বোধগম্য করে সহজভাবে বিন্যস্ত করিয়েছেন। এই চার মাযহাবের উপর আমল এতটাই ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, বিভিন্ন অঞ্চলে এই চার মাযহাব পঠন পাঠন এবং তদানুযায়ী আমল করন তাওয়াতুরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে অপূর্ণাঙ্গ অসঙ্কলিত তাওয়াতুরবিহীন মাযহাবসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে শুরু করল এবং সকলেই এই চার মাযহাবের দিকে ঝুঁকে পড়ল। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেন-
ولما اندرست المذاهب الحقة إلا هذه الأربعة كان اتباعها اتباعا للسواد الأعظم والخروج عنها خروجا عن السواد الأعظم
‘যখন (অসঙ্কলিত এবং তাওয়াতুরবিহীন) হক মাযহাবসমূহ বিলুপ্ত হয় গেল আর হক মাযহাবসমূহের মধ্যে কেবল (সঙ্কলিত ও তাওয়াতুর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত) এই চার মাযহাব বিদ্যমান রয়ে গেল তখন এগুলোর তাকলীদ করার অর্থই হল ‘সাওয়াদে আজম’ তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুসরণ আর এই চার মাযহাব থেকে বের হয়ে যাওয়ার অর্থই হল সাওয়াদে অজম থেকে বের হয়ে যাওয়া।’ ঈকদুল জীদ : ৩৮
এই আলোচনা দ্বারা ঐ মিথ্যা অপপ্রচারের
স্বরূপ উদঘাটিত হয়ে গেলে যে, চার ইমামের মাযহাবের পূর্বে শুধুমাত্র একটিই ইজাতেহাদী মাযহাব ছিল তারা ‘এক’কে চার এ পরিণত করেছেন অথচ প্রকৃত সত্য হল- হাজারো মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে ‘চার’ এ সীমাবদ্ধ হয়েছে।
আল্লামা শা’রানী রহ. এর অনন্য কাশফ
আল্লামা শা’রানী রহ. বলেন- মহান আল্লাহ পাক যখন আমার প্রতি এই অনুগ্রহ করলেন যে, আমাকে শরীয়তের উৎসমূলের ব্যাপারে অবহিত করলেন তখন আমি সমস্ত মাযহাবকে দেখতে পেলাম যে, এগুলো একই উৎসমূলের সঙ্গে যুক্ত ও সংযুক্ত আর তন্মধ্যে চার ইমামের মাযাহাবের নহর প্রবল বেগে বহমান আর যে সব মাযহাব বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলো শুকিয়ে পাষাণ পাথরে পরিণত হয়েছে।
আর চার ইমামের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা রহ. এর নহর সর্বাধিক দীর্ঘ ও বিস্তৃত দেখতে পেলাম, তারপর তার কাছাকাছি ইমাম আহমদ রহ. এর নহরকে দেখতে পেলাম আর সবচেয়ে ক্ষুদ্র ইমাম দাউদ রহ. এর নহরকে দেখতে পেলাম যা পঞ্চম শতাব্দীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে আমি একথা বুঝতে পারলাম- চার ইমামের মাযহারের উপর আমল যুগ যুগ ধরে অব্যাহত রয়েছে আর ইমাম দাউদ রহ. এর মাযহাবের উপর কেবল কয়েক শতাব্দী যাবত আমল হয়েছে। সুতরাং ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মাযহাবের সঙ্কলন যেহেতু অন্যান্য সঙ্কলিত মাযহাবসমূহের পূর্বে হয়েছে তদ্রূপ তার সমাপ্তিও অন্যান্য মাযহাবসমূহের পরে ঘটবে। এটাই আহলে কাশফ তথা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী মনীষীদের বক্তব্য। মীযানে শা’রানী উর্দূ সংস্করণ : ১০৭
ঐতিহাসিক সত্য ও হাকীকত
আধুনিক সমাজ-বিজ্ঞানের জনক জগদ্বরেণ্য ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুন এ প্রসঙ্গে লিখেন- গোটা মুসলিম জনপদে এই চার মাযহাবের তাকলীদ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এই চার মাযহাব ছাড়া যত মাযহাব ছিল তাদের অনুসারীরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে (তাই তাদের মাযহাব বিলীন হয়ে গেছে) আর বিশিষ্টজন (উলামাগণ) এই চার মাযহাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন কিছু করার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। আর যেহেতু ইলমী পরিভাষার মধ্যে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা সৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই আলেমগণ ইজতেহাদের স্তরে পৌঁছতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। আর যখন এই আশঙ্কা সৃষ্টি হল- এমন লোক ইজতেহাদের দাবী করতে শুরু করবে যে ইজতেহাদের উপযুক্তই না এবং তার রায় ও দ্বীনদারী কোনোটাই আস্থাযোগ্য নয়, তখন পরবর্তী উলামায়ে কেরাম ইজতেহাদের ব্যাপারে নিজেদের আপারগতা প্রকাশ করেছেন এবং তা সুকঠিন বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। আর লোকজন ব্যাপকভাবে যে ইমামদের তাকলীদ করতে শুরু করেছিলেন তারাও জনসাধারণকে তাদের তাকলীদ করার প্রতি অনুপ্রাণিত করতে শুরু করলেন। একই সঙ্গে চারজনের তাকলীদ (অর্থাৎ যে মাসআলায় যে মাযহাবে সুবিধা ঐ মাসআলায় ঐ মাযহাবের অনুসরণ করা যেহেতু দীন নয় বরং একটা খেলমাত্র) যেহেতু একটা খেলমাত্র তাই কখনও একজনের তাকলীদ কখনও আরেকজনের তাকলীদ করা কঠোরভাবে নিষেধ করতে থাকেন, এই পরিপ্রেক্ষিতে কেবল ‘নকলে মাযহাব’ তথা মুজতাহিদকর্তৃক সঙ্কলিত মাযহাবের মাসআলা মাসায়েল বর্ণনা এবং আমল করার প্রচলন শুরু হল। তারপর বিশুদ্ধ মূলনীতি ও রেওয়ায়েতের অবিচ্ছিন্ন সূত্রধারার ভিত্তিতে প্রত্যেক মুকাল্লিদ অপন মুজতাহিদ ইমামের তাকলীদ করতে শুরু করল। বর্তমান যুগে ইলমে কিকহের এছাড়া ভিন্ন কোন মর্ম ও মতলব নেই। বর্তমান যুগে ইজতেহাদের দাবীদার প্রত্যাখ্যাত ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য হবে। আর গোটা মুসলিমউম্মাহ এই চার ইমামের তাকলীদের উপর কায়েম ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মুকাদ্দামা ইবনে খালদুন
একটি চ্যালেঞ্জ
যেভাবে আমি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলীল প্রমাণের আলোকে সাব্যস্ত ও প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি যে, চার মাযহাবের পূর্বে এমন বহু মাযহাব ছিল যা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, প্রকৃতপক্ষে চার মাযহাব মূলত মাযহাবী ইখতেলাফ ও মতবিরোধকে বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়েছে। গায়রে মুকাল্লিদগণ যেন এমন একটিমাত্র বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেশ করে যে, চার মাযহাবের পূর্বে কোন শাখাগত ইখতেলাফ ও মতবিরোধ ছিল না আর এই চার মাযহাব এসে এক মাযহাবকে চার মাযহাবে পরিণত করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও তারা এমন একটিমাত্র প্রমাণও পেশ করতে পারবে না, তাই তাদের কর্তব্য হল এই মিথ্যা অপপ্রচার থেকে তওবা করা।
তাকলীদ অস্বীকারকারীদের বিধান
আমি তিন ধরনের ইখতেলাফ ও মতবিরোধের কথা আলোচনা করেছি-
এক. স্বয়ং দ্বীন ধর্মের ক্ষেত্রেই ইখতেলাফ ও মতবিরোধ। দ্বীন থেকে বের হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে বেদ্বীন ও কাফের বলা হয় আর আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাতের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে আহলে বেদআত বা বেদআতী বলে আর চার মাযহাব থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে লামাযহাবী বলে আর এটা এমন এক হাকীকত যা গায়রে মুকাল্লিদরাও স্বীকার করে। তাই তো গায়রে মুকাল্লিদের প্রসিদ্ধ আলেম ও ঐতিহাসিক মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহানপুরী ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে আপন কিতাব الإرشاد إلى سبيل الرشاد নামক গ্রন্থে লিখেন- কিছু দিন যাবত ভরত উপমহাদেশে এমন এক আপরিচিত মাযহাবের লোক দেখা যাচ্ছে যাদের সম্পর্কে মানুষজন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। পূর্ব যুগে এধরনের লোক এক্কা দুক্কা কোথাও থেকে থাকবেন কিন্তু (বর্তমানের মত) এত বেশি দেখা যায়নি বরং এদের নাম দাম এই কিছু দিন হল শুনতে পেয়েছি। নিজেদেরকে তারা আহলে হাদীস মুহাম্মাদী কিংবা মুওয়াহহিদ বলে পরিচয় দিয়ে থাকে কিন্তু বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে তাদেরকে গায়রে মুকাল্লিদ, ওয়াহাবী কিংবা লামাযহাবী বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আল ইরশাদ : ১৯
এ উদ্বৃতি থেকে বোঝা গেল, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের লোকজন তাদেরকে প্রথম দিন থেকে লা মাযহাবী নামে স্মরণ করে থাকে। মাত্র কিছু দিন পূর্বে তাদের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে সাঈদ রামাদান সাহেবের কিতাব প্রকাশিত হয়েছে তার নাম হল اللامذهبية অর্থাৎ লা মাযহাবিয়্যাত। আর ভারত থেকে মাওলানা আবু বকর গাজীপুরী আরবী ভাষায় যে গ্রন্থ রচনা করছেন তার নামও এই وقفة مع اللامذهبية في شبه القارة الهندية ওয়াকফা মাআল্লামাযহবিয়্যাহ… আরব আজমের দুই শীর্ষস্থানীয় আলেমের দুটি গ্রন্থের নামকরণ থেকে বোঝা যায় যে, তাদের লা মাযহাবী হওয়ার ব্যাপারে আরব অনারবের শীর্ষস্থানীয় সকল আলেম পুরোপুরি একমত। হ্যাঁ তারা নিজেদের যে আহলে হাদীস নাম রেখেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। কেননা যেভাবে তাদের স্বগোত্রীয় বড় ভাই ‘আহলে কোরআন’ কোরআন শরীফের কোথাও একথা দেখাতে পারবে না যে, মুনকিরীনে সুন্নত বা সুন্নত আস্বীকার-কারীদের ‘আহলে কোরআন’ বলে ডেকো। তদ্রূপ তাদের স্বগোত্রীয় ছোট ভাই তথাকথিত আহলে হাদীসরাও তাদের নামের স্বপক্ষে এমন কোন হাদীস পেশ করতে পরবে না যে মুনকিরীনে ফিকহ তথা ফিকহ আস্বীকার-কারীদেরকে ‘আহলে হাদীস’ নামে ডেকো। তবে হ্যাঁ একটি হাদীস এমন আছে-
فقيه واحد أشد على الشيطان من ألف عابد
একজন ফকীহ শয়তানের উপর হাজারো আবেদের চেয়ে ভারী। ইবনে মাজাহ, হাদীস নং : ২২২
এই হাদীস থেকে বোঝা গেল ফিকহের বিরোধিতাকারী সাক্ষাৎ শয়তান।
মোটকথা তারা নিজেদের নামই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত করতে পারেনি আর না কিয়ামত পর্যন্ত একথা প্রমাণ করতে পারবে যে, হাদীসের কোন উৎসগ্রন্থ গায়রে মুকাল্লিদ লামাযহাবী ব্যক্তি লিখেছে এবং তার লেখক এই দাবী করেছে যে, আমি না মুজতাহিদ না মুকাল্লিদ; বরং আমি গায়রে মুকাল্লিদ, আর তিনি তাঁর কিতাবের প্রথম অধ্যায়কে মুজতাহিদ ইমামগণকে ইবলীস এবং মুকাল্লিদদেরকে মুশরিক সাব্যস্ত করার জন্য উৎসর্গ করেছেন। তদ্রূপ মুহাম্মদী হওয়ার দাবীটা একমাত্র তাদের বৈশিষ্ট্য নয়, তিয়াত্তর দলের প্রত্যেকটি দলই মুহাম্মদী, আর গায়রে মুকাল্লিদদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কাদিয়ানীরাও মুহাম্মদী ও একত্ববাদী! অর্থাৎ একত্ববাদী সকলেই মুসলমান!!
নবাব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবের অকপট স্বীকাররোক্তি
নবাব সিদ্দীক হাসান খান সাহেব এই কথা অকপটে স্বীকার করেছেন-
یہ لوگ اپنے دین میں وہی آزادگی برتتے ہیں جسکا اشتہار بار بارانگریزی سرکار سے جاری ہوا، خصوصا دربار دہلی میں جو درباروں کا سردار ہے
এ শ্রেণির লোকগুলো আপন ধর্মের বেলায় ঐ ধরনের লাগামহীনতা প্রর্দশন করে যার ইশতেহার বার বার ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে জারি হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লীর দরবার থেকে যা সব দরবারের সরদার। তরজুমানে ওয়াহহাবিয়া : ৩২
তিনি আরও লিখেন-
یہ آزادگی ہماری مذاہب جدیدہ(حنفی، شافعی وغیرہ۔ ناقل) سے عین مراد قانون انگلشیہ ہے
প্রবর্তিত নতুন মাযহাবসমূহ (হানাফী, শাফী ইত্যাদি) থেকে মুক্তি ও আযাদীর একমাত্র উদ্দেশ্য হল ইংরেজ প্রবর্তিত আইন কানুন (অর্থাৎ চার মাযহাব বাদ দিয়ে জনসাধারণকে ইংরেজ প্রবর্তিত আইনের অনুসারী বানানো)।
লক্ষ করুন, কী পরিষ্কার অকপট স্বীকারোক্তি- মাযহাব থেকে মুক্ত হয়ে গেলাম অর্থাৎ লামাযহাবী হয়ে গেলাম। কিন্তু তা এ জন্য নয় যে, কোরআন হাদীসের কোথাও এর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে; বরং রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজকীয় ফরমান ও ইশতেহারের কারণে মাযহাব তরক করলাম তাই তো ইংরেজ আইন এই লামাযহাবীদেরকে নিজের পরম আত্মজন হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।
এক নব্য লামাযহাবীর চমকপ্রদ ঘটনা
মাওলানা মনসুর আলী সাহেব বলেন, নতুন নতুন বিগড়ে যাওয়া এক লামাযহাবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল।
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার মাযহাব কী?
সে উত্তর দিল, আমি মুহাম্মদী।
আমি বললাম, সুবহানাল্লাহ। আমি প্রশ্ন করলাম কী আর আপনি উত্তর দিলেন কী। আপনার কাছ থেকে দ্বীনে মুহাম্মদী সম্পর্কে জানতে চাওয়া তো আমাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল মাযহাব সম্পর্কে জানতে চাওয়া আর দ্বীন এবং মাযহাবের মধ্যে ব্যাপকতা এবং বিশিষ্টতার বড় পার্থক্য রয়েছে। আপনি যখন আমাদের সঙ্গে মসজিদে নামায পড়েছেন, আমার সালামের ইসলামী জবাব দিয়েছেন আর নামও বলেছেন মুসলমানদের নামের মতই তাতেই আপনার মুহাম্মদী হওয়ার বিষয়টি আমি বুঝতে পেরেছি। যদি আপনার মুসলমান হওয়া আমাদের জানা না থাকত এবং আমি আপনাকে ইহুদী বা খ্রিস্টান মনে করতাম তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরে আপনার মুহাম্মদী বলা যথার্থ হত। (অর্থাৎ যে বিষয়টি আমার পূর্ব থেকে জানা ছিল তা সম্পর্কে প্রশ্ন করা ছাড়াই আমাকে বলে দিয়েছেন আর যে সম্পর্কে আমার প্রশ্ন ছিল সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা সত্ত্বেও আপনি কিছু বলেন নি।)
তারপর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি অলঙ্কার শাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করেছেন? যাতে আপনাকে কথা বুঝানো যায় এবং আপনি কথা বুঝতে পারেন।
তিনি উত্তর দিলেন, এগুলো কোন দ্বীনি ইলম নয়; বরং বেদআত সুতরাং এসব পড়তে যাব কেন?
আমি : সত্য বলেছেন, আপনার কাছ থেকে আমার প্রশ্নের অযুৎসই উত্তর শুনেই আমি আপনার জ্ঞান-গরিমার দৌড় সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে গিয়াছিলাম। এখন ইলমগুলোকে বেদআত বলায় সে সম্পর্কে আরও ভালভাবে ধারণা পেলাম। কবির ভাষায়,
پہلے ہی سےنہ انکی تھی کچھ قدر ومنزلت مضمون خط نے اور ڈبو دی رھی سھی
পূর্ব থেকেই আমার দৃষ্টিতে তার কোন মূল্য ও মূল্যায়ন ছিল না, যা ছিল তাও ডুবিয়ে দিল তার চিঠির ভাষ্য (কিংবা মুখের ভাষ্য) তারপর লামাযহাবী জানতে চাইল, মাযহাব সম্পর্কে প্রশ্ন করার পেছনে আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী, আমি তো আহলে হাদীস, হাদীস মোতাবেক প্রশ্ন করুন এবং উত্তর নিন।
আমি বললাম, একটি হাদীস শুনুন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে তিয়াত্তরটি দল ও ফেরকা সৃষ্টি হবে। তন্মধ্যে বাহাত্তরটি দোযখী এবং মাত্র একটি জান্নাতী হবে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করেছেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই জান্নাতী দল হবে কোনটি? উত্তরে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেই দল হল ঐ দল যার তরীকা আমার সুন্নত মোতাবেক এবং আমার সাহাবাদের সীরাত ও চরিত মোতাবেক। আর তারা হল, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত।
আমি যে আপনার কাছে জানতে চাইলাম, আপনার মাযহাব কী? এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল আপনি জাবরী, কাদরী ইত্যাদি দোযখী ফেরকার অর্ন্তভুক্ত না হানাফী শাফী ইত্যাদি জান্নাতী ফেরকার অন্তর্ভুক্ত যাতে হক ও বাতিল এবং মুক্তিপ্রাপ্ত ও সাজাপ্রাপ্তের মধ্যে পার্থক্য হয়ে যায়। আর আপনার উত্তর ‘মুহাম্মদী’ এই শব্দ দ্বারা আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য হাসিল হয়নি। কারণ তিয়াত্তর ফেরকার সকলেই মুহাম্মদী। আপনার মুহাম্মদী হওয়াতো আমার জানা আছে কিন্তু দোযখী মুহাম্মদী না জান্নাতী মুহাম্মদী তা পরিষ্কার হল না। কারণ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হল, মুক্তিপ্রাপ্ত দল হল চার মাযহাব- হানাফী, শাফী, হাম্বলী এবং মালেকী।
আমার বক্তব্য শুনে লামাযহাবী সাহেব তার তাৎক্ষণিক কোন সদুত্তর দিতে না পেরে একেবারে বিচলিত হয়ে পড়লেন। আর বলতে লাগলেন, আমরা এবং আমাদের বাপদাদা সমস্ত পূর্বপুরুষ হানাফী ছিলাম। কিন্ত এক লামাযহাবী আমাকে বিপথগামী করার ফলে নিজের নাম রেখেছি মুহাম্মদী। (কাদিয়ানীরা মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক বিপথগামী হওয়ায় নিজেদের নাম দিয়েছে আহমদী) এর বিস্তারিত বিবরণ হল নিম্নরূপ, সেই লামাযহাবী আমাকে এভাবে প্রশ্ন করল, তুমি কার কলেমা পড়?
আমি : মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর।
লা মাযহাবী : শাবাশ। তারপর প্রশ্ন করল, কবরে যখন মুনকার নাকীর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম জিজ্ঞেস করবেন তখন কী বলবে?
আমি : মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লা মাযহাবী : মারহাবা। তারপর সে প্রশ্ন করল, কিয়ামত দিবসে কে তোমার জন্য সুপারিশ করবে?
আমি : মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
লা মাযহাবী : শাবাশ জাযাকাল্লাহ। তারপর মন্তব্য করল, ইহলোকে বরযখে এবং পরলোকে যার নামের উছিলায় তোমার মুক্তি ও নাজাতের ফায়সালা হবে আফসোস! তাকে ছেড়ে তুমি হানাফী হয়ে গেছ! আল্লাহর বান্দা মুহাম্মদী হও। আর কেউ তোমাকে মাযহাব সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মুহাম্মদী বলে পরিচয় দাও। তো সে দিন থেকেই আমি নিজেকে মুহাম্মদী বলে পরিচয় দিতে লাগলাম। কিন্তু এই সূ² বিষয়টি ধরতে পারিনি যে, মুহাম্মদী বলে পরিচয় প্রদানের ফলে একটি জানা শোনা বিষয়কে পুনরায় জানানো ছাড়া বাড়তি কোন ফায়দা নেই। আর না প্রশ্নকারী এই উত্তর দ্বারা কোন সন্তোষজনক উত্তর পায়। এমনকি এই উত্তর প্রশ্নকারীর উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এখন আমি ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছি যে, হানাফী হওয়া কিছুতেই মুহাম্মদী হওয়ার পরিপন্থী নয়; বরং হানাফীও মুহাম্মদী (পাঞ্জাবী হওয়া পাকিস্তানী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় নয়; বরং পঞ্জবীও পাকিস্তানী) পক্ষান্তরে মুহাম্মদী বলে পরিচয় প্রদান করলে সমস্ত ভ্রষ্ট ফেরকা (৭২টি দোযখী) তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার মত জঘন্য কাজটি ঘটার ফলে সুষ্ঠু পরিচয় স্বাতন্ত্র্যও বোঝা যায় না। আল ফাতহুল মুবীন : ৩৭১
উদ্বৃত গ্রন্থ আল ফাতহুল মুবীন কিতাবের মধ্যে আরব অনারব ৪৬৬ জন আলেম-উলামার স্বাক্ষর রয়েছে। এতে বোঝা যায় গায়রে মুকাল্লিদদের জন্য ‘লা মাযহাব’ নামটি আরব-অনারব উলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে রেজিস্ট্রিকৃত।
বাপ-মা বিহীন
গায়রে মুকাল্লিদদের ইমাম জনাব মাওলানা মুহাম্মদ ইবরাহীম সিয়ালকোটি বলেন, আমাদের আহলে হাদীস সম্পর্কে আমাদের হানাফী ভাইরা কি এ ধারণা পোষণ করেন যে, আমরা নিঃশর্ত তাকলীদ অস্বীকার করি আর জনসাধারণকে একথা শিক্ষা দেই যে, ‘প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী কিংবা সাহাবাদের ফায়সালা না পাওয়া এবং প্রচলিত ফাতাওয়া ও মাসায়েলের কিতাবাদি থেকে মাসায়েল বোঝার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ইমামগণের মতামতকে প্রত্যাখ্যান কর।’ নাউযুবিল্লাহ। ‘বাপ-মা মুক্ত বা বাপ-মা বিহীন হয়ে যা খুশি তাই কর।’ যদি তারা এমনটা মনে করে থাকে তাহলে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছি যে, তারা আমাদের মাসলাক ও মতাদর্শ বুঝার ক্ষেত্রে তাহকীক ও গভীর অনুসন্ধানের আশ্রয় নেয়নি। তারীখে আহলে হাদীস : ১২৪
এই ভাষ্যে মাওলানা সাহেব ইমামদের মতামত প্রত্যাখানকারী তার স্বগোত্রীয়দের ‘বাপ-মা মুক্ত’ বা ‘বাপ-মা বিহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
লাগামহীন উট
গায়রে মুকাল্লীদ জামাতের আমীর মাওলানা দাউদ গযনবী বলেন, যদি কেউ একথা মনে করে যে, আমরা তাকলীদকে নিঃশর্ত অস্বীকার করি এবং জনসাধারণকে একথা শিক্ষা দেই যে, তারা তাফসীর, হাদীস ও ফিকহের ব্যাপারে অজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও ইমামদের মতামতকে প্রত্যাখ্যান করুক এবং লাগামহীন বেপরোয়া হয়ে যাক তাহলে তারা নির্ঘাৎ ভুল ধারণায় আছে। দাউদ গযনবী : ৩৭৩
মাওলানা গযনবী ইমামদের মতামত প্রত্যাখ্যানকারীদের যেন প্রকারান্তরে লাগামহীন উট বলে আখ্যায়িত করলেন। আমার কাজ এতে এটুকু যে, তাকলীদের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া লোকদেরকে আরব অনারবের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম লামাযহাব, মাওলানা সিয়ালকোটি বাপ-মা মুক্ত বা বাপ-মা বিহীন আর মাওলানা গযনবী লাগমহীন উট বলে আখ্যায়িত করেন। এখন আপনার এখতিয়ার পছন্দ হলে সবগুলোই গ্রহণ করতে পারেন নতুবা তিনটার কোন একটা নির্বাচন করতে পারেন। কবির ভাষায়-
نظر اپنی اپنی پسند اپنی اپنی
দৃষ্টি যার যার বাছাই ও নির্বাচনও যার যার।
চার মাযহাব
সারকথা হল, আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত এই চার মাযহাবেই সীমাবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. লিখেন-
وليس مذهب في هذه الأزمنة المتأخرة بهذه الصّفة إلَّا هذه المذاهب الأربعة اللهم إلا مذهب الإمامية والزيدية وهم أهل البدعة
অর্থ : বর্তমান আখেরী যামানায় এই চার মাযহাব ছাড়া কোন হক মাযহাব নেই। হ্যাঁ তবে ইমামিয়া (শিয়া) যায়দিয়া (শিয়াদের আরেকটি দল) আছে আর তারা আহলে বেদাআত (পথভ্রষ্ট জামাত)। ইক্দুল জীদ : ৩৭
পূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, যারা এই চারো মাযহাবের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গেল তারা সাওয়াদে আজম ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত থেকে বেরিয়ে গেল আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে বা যারা সাওয়াদে আজম তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সে বা তারা জাহান্নামী। তাই তো ইমাম তাহতাবী রহ. দুররে মুখতারের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, যারা এই চার মাযহাব থেকে বের হয়ে গেল তারা বেদআতী ও জাহান্নামী।
শেষ কথা
নবীবংশধর শেরে খোদা হযরত আলীর রাযি. এর সুযোগ্য অধঃস্তন পুরুষ পৃথিবীবিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের সাবেক নাজেমে তালীমাত হযরত মাওলানা সৈয়দ মুরতাজা হাসান চাঁদপুরী রহ. বলেন, বর্তমান যুগে কিছু সংখ্যক আহলে হাদীস যারা ইমামদের তাকলীদকে শিরক ও বেদআত আখ্যায়িত করে এবং ইমামদের শানে গোস্তাখী ও অবমাননাকর উক্তি করে আর ফিকহকে শিরক ও মুকাল্লিদদেরকে মুশরিক বলে বেড়ায়। আর তাদেরকে তারা (ইহুদী খ্রিস্টানরা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের ধর্মগুরু ও পাদ্রিদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে) আয়াতের লক্ষ্যবস্তু আখ্যায়িত করে থাকে, এ ধরনের লোকদের আমরা পথভ্রষ্ট, বদ দ্বীন এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত বহির্ভূত বলে বিবেচনা করি আর তাদের মধ্যে যাদের আকাঈদ কুফুরী পর্যন্ত পৌছে গেছে কিংবা তারা জরুরিয়াতে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত কোন কিছু আস্বীকার করে থাকে, তাদেরকে কাফের মনে করে থাকি।
অবশেষে দোআ করছি মহান আল্লাহ পাক যেন আমাদের সকলকে মুক্তিপ্রাপ্ত জামাত আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সঙ্গে যুক্ত রাখেন। আমীন।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট