‪#‎_হিজরি_সাল_শুরুর_কথা‬

দিন, মাস, বছর গণনার তাগিদে মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই বর্ষ গণনার উদ্ভব ঘটেছে। আর এ গণনার পথপরিক্রমায় মানুষ চাঁদের গতি হিসাব করেছে। যার থেকে জন্ম হয়েছে চান্দ্রবর্ষের। আবার সূর্যের গতিপথ ধরে সৌরসনের জন্ম হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'তিনিই সূর্যকে করেছেন তেজস্বী এবং চন্দ্রকে জ্যোতির্ময়। আর চন্দ্রের জন্য নির্ধারিত করেছেন মনজিলসমূহ (কলাসমূহ), যেন তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার।' (সূরা ইউনুস : ৫)।
প্রাচীন আরবের লোকেরা মহররম থেকে জিলহজ- এ ১২টি মাসের নাম ব্যবহার করলেও গোত্রীয় নানা প্রয়োজনে মাসগুলোকে ইচ্ছামতো আগ-পিছ করে নিত। মহান আল্লাহর কুদরতে বিদায় হজের দিন মাসগুলো যথারীতি আপন আপন জায়গায় স্থিতি লাভ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সেদিন এরশাদ করেন, 'আসমান-জমিন সৃষ্টির দিন যে বিন্যাসে আল্লাহ তায়ালা মহাকালকে বিন্যস্ত করেছিলেন আবার সে বিন্যাসেই তা ফিরে এসেছে।' (মুসলিম : ৪৪৭৭)।
ইসলামী খেলাফতের সীমানা তখন প্রায় অর্ধজাহান বিস্তৃত। তখনকার কুফার গভর্নর বিশিষ্ট সাহাবি আবু মুসা আশ'আরি (রা.) খলিফাতুল মুমিনিন বরাবর একটি পত্র প্রেরণ করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, 'দরবারে খেলাফত থেকে প্রায়ই বিভিন্ন উপদেশ, পরামর্শ ও নির্দেশ সংবলিত চিঠিপত্র আমাদের কাছে আসে। তবে সেগুলাতে সনের উল্লেখ না থাকায় যথাসময়ে বাস্তবায়ন ও কার্যকর করতে আমাদের বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়।' গুরুত্বপূর্ণ পত্রটি হস্তগত হওয়ার পর খলিফা ওমর (রা.) নেতৃস্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করেন। সাহাবায়ে কেরাম হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী সালের গণনা শুরু করার সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেন। ঐতিহাসিক এ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে।
ইসলামী বছরের প্রথম মাস হবে কোনটি- এক্ষেত্রে যথাক্রমে রজব, রমজান, মহররম ও রবিউল আওয়াল এ চারটি মাসের নাম প্রস্তাবিত হলেও মহররম মাসই হবে হিজরি সনের প্রথম মাস এ মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পূর্বপুরুষ কিলাব বিন মুররার যুগ তথা ইসলাম আবির্ভাবের প্রায় ২০০ বছর আগে থেকেই মহররম মাসটি বছরের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। প্রচলিত ধারাটি ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হওয়ায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে সেটিকে পূর্ববৎ বহাল রাখা হয়। তাছাড়া হিজরতের মূল পরিকল্পনা জিলহজ মাসে অনুষ্ঠিত 'আকাবার' দ্বিতীয় শপথ থেকে হয়। তাই জিলহজের পরবর্তী নতুন চাঁদ তথা মহররম মাস থেকে হিজরি সন গণনা শুরু হওয়া যুক্তিযুক্ত বলেও পরিগণিত হয়।
জাতি-ধর্ম ভেদে নববর্ষ উদযাপনের একটি প্রথা লক্ষ করা যায় পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই। যেসব বর্ষপঞ্জির ভিত্তি কারও জন্ম বা অন্য কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে, সেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাতি বা গোষ্ঠী বেশ ঘটা করে নববর্ষ উৎসব পালন করে। অনেক জাতি আবার নতুন বছর আসছে শুধু সে আনন্দেই উচ্ছ্বসিত হতে থাকে। হিজরি বর্ষ কোনো গতানুগতিক বর্ষপঞ্জি নয়। এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে অভূতপূর্ব এক ত্যাগকে কেন্দ্র করে। যেন এই বর্ষ সংশ্লিষ্ট সবাই সারা বছর তো বটেই, বিশেষ করে নতুন বছরে দ্বীনের জন্য নবী (সা.) এর সীমাহীন ত্যাগের কথা স্মরণ করে এবং নিজেদের মধ্যে এর প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
প্রতিটি নতুন হিজরি বর্ষ গোটা মুসলিম জাতিকে দ্বীনের জন্য ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় আনন্দ-উৎসব নয়, বছর শেষে গেল বছরের আমলের জমা-খরচ মিলিয়ে দেখার পালা। সময় আসে দ্বীনের জন্য কতটুকু করা হলো তার হিসাব-নিকাশ কষার। প্রস্তুতি নিতে হয় আগামীর জন্য। শুধু বছরের শুরু কেন, প্রতিটি নতুন চাঁদে আমাদের জন্য ঈমান-ইসলামের মজবুতি ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি কামনায় প্রয়াসী হওয়ার হেদায়েত দেয়া হয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) আমাদের প্রতিটি নতুন চাঁদ দেখার সময় দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। 'আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল ইউমনি ওয়াল ঈমান ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম। রাবি্ব ওয়া রব্বুকাল্লাহ।' অর্থাৎ 'হে আল্লাহ! শান্তি-নিরাপত্তা ও ঈমানের বারতা দিয়ে ওই চাঁদের উদয় ঘটাও। ও চাঁদ! তোমার-আমার প্রভু হলেন আল্লাহ।' (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ৯৭৩৪)।
দিনের শেষে একজন আদর্শ ব্যবসায়ী সারা দিনের হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকেন। হিসাব মেলার আগে তার অন্য কাজের ফুরসত কোথায়? এমনকি এর আগে খাবারের সুযোগটুকুও হয় না তার। ঠিক তেমনি বছর শেষে গেল বছরের ডেবিট-ক্রেডিট মেলাতে ব্যস্ত হন একজন সফল বণিক। লাভ হলে সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখে আর লোকসান হলে পুষিয়ে নেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় ব্রত হয়। ঠিক তেমনিভাবে একজন মোমিনও প্রতিদিন ঘুমানোর আগে তার সারা দিনের আমলের হিসাব করবে এটাই স্বাভাবিক। আর বছর শেষে গোটা বছরের দ্বীনি উন্নতি-অগ্রগতির হিসাব কষবে। একটি নতুন বছর আমাদের দোরগোড়ায়। আমরা জীবনকে কতটুকু এগিয়ে নিতে পেরেছি- এ হিসাব কষার সময় কি আমাদের কাছে আছে? নতুন বছরে আমরা কতটুকু এগিয়ে যেতে চাই সেটি আমরা ক'জনে ভাবছি? নাকি হররোজ চলেছি গতানুগতিক ধারায়?

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট