# মদিনায় হিজরতের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

ইসলামের প্রথম মসজিদ : হিজরতকালে মদিনার কুবা পল্লীতে মহানবী (সা.) এখানে নামাজ আদায় করেন - 

আল্লাহ তার ইবাদতের জন্য মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী ও রাসুলদের প্রেরণ করেছেন। তারা দিন-রাত মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পথে। কিন্তু উম্মতের সব মানুষ নবীদের দাওয়াত কবুল করেনি। বরং সিংহভাগ মানুষ তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং আল্লাহর এই প্রিয় বান্দাদের নানাভাবে অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছে। তাদের ইবাদতে-দাওয়াতে বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এমনকি তাদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে এবং হত্যার যড়যন্ত্র করা হয়েছে।
মাতৃভূমির আকর্ষণ ত্যাগ করে, আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজনের মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহর রাহে বাড়িঘর ত্যাগের এ মহান গুরুত্বপূর্ণ আমল যেমন বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের জন্য খোদাপ্রেমের কঠিন পরীক্ষা, তেমনি তাতে নিহিত থাকে আল্লাহর সাহায্যের সূচনা। যেসব নবীর জীবনে হিজরতের ঐশী আদেশ এসেছে, তা এসেছে চূড়ান্ত পরীক্ষা ও বিজয়ের সূচনা হিসেবে। উদাহরণস্বরূপ ইবরাহিম (আ.) এর কথা বলা যেতে পারে। নবুয়ত লাভের পর থেকে তিনি নিজ মাতৃভূমির মানুষকে রাত-দিন দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করেনি তারা, ত্যাগ করেছে তার সঙ্গ। তাকে অকথ্য নির্যাতন করতেও দ্বিধা করেনি। দ্বিধা করেনি তাকে জ্বলন্ত অগি্নকু-ে নিক্ষেপ করতে। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে সিরিয়ায় হিজরতের নির্দেশ আসে। তাই তিনি ঘোষণা করেন, 'নিশ্চয়ই আমি আমার রবের দিকে হিজরত করছি, তিনি মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।' (সূরা আনকাবুত : ২৬)।
তার এই হিজরতের ফলে সূচিত হয় এক বিপ্লবের। আসে ব্যাপক সফলতা ও আল্লাহর সাহায্য। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, 'যখন তিনি (ইবরাহিম আ.) মাওলার সন্তুষ্টির জন্য স্বীয় কওমকে ত্যাগ করলেন এবং সে দেশ থেকে হিজরত করলেন, তখন তার স্ত্রী ছিলেন বন্ধ্যা ও নিঃসন্তান। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। ছিল শুধু ভাতিজা লুত ইবনে হারুন ইবনে আজর। হিজরতের পর আল্লাহ তাকে অনেক নেক সন্তান-সন্ততি দান করলেন। তার বংশে দেওয়া হলো নবুয়ত ও আসমানি কিতাব। এরপর পৃথিবীতে যত নবী তশরিফ এনেছেন তারা সবাই ইবরাহিম (আ.) এর বংশধর। এরপর জমিনে যত আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে তা নাজিল হয়েছে ইবরাহিম (আ.) এর সন্তানের ওপর। এটি আল্লাহ প্রদত্ত সম্মান ও অপার অনুগ্রহ। কেননা, তিনি তারই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিজ ভিটেমাটি ও স্বজন-পরিজনকে ত্যাগ করেছেন। এমন ভূমির দিকে হিজরত করেছিলেন যেখানে নিরাপদে আল্লাহর ইবাদত করা যায় এবং তার পথে মাখলুককে দাওয়াত দেয়া যায়।' (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১/৩৪৬)।
এই ধারায় হিজরত করেছেন আল্লাহর বহু নবী-রাসুল। সবার হিজরতের অক্লান্ত কষ্টের মাঝেই লুকিয়ে ছিল প্রাপ্তির সু-সংবাদ আর বিজয়ের সূচনা। নিহিত ছিল ইবাদাতের স্পৃহা আর ঈমানের তেজসহ আরও অসংখ্য হিকমত, যা আল্লাহই ভালো জানেন। এ ধারায় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনেও হিজরতের মহান ত্যাগের স্বাক্ষর রাখতে হয়।
যখন কাফেরদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে, তখন আল্লাহ তার সাহায্য ও নুসরত, দ্বীনের বিজয়, কালেমার বিশ্বময় প্রসারের জন্য মোমিনদের সর্বশেষ পরীক্ষার আয়োজন করেন। নবীজি আল্লাহর হুকুমে তাঁদের নির্দেশ দিলেন মদিনায় হিজরতের। বোখারির বর্ণনা মতে, 'আবু বকর (রা.)ও অন্য সাহাবিদের মতো হিজরতের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু নবীজি তাকে বললেন, অপেক্ষা করো, আশা করছি আমাকেও হিজরতের অনুমতি দেয়া হবে। ... অতঃপর আবু বকর (রা.)ও নবীজির সঙ্গী হতে রয়ে গেলেন মক্কায়। আর সফরের প্রস্তুতিস্বরূপ প্রায় চার মাস ধরে দুটি উট বাহনের পরিচর্যা করতে লাগলেন।' (বোখারি : ৩৯০৫)।
হিজরতের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়িতে আপন চাচাতো ভাই আলী (রা.) কে রেখে নবীজি বের হলেন। আবু বকর (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে পরদিন বের হলেন মদিনার পথে। রওনা হওয়ার মুহূর্তে বাইতুল্লাহর দিকে করুণ দৃষ্টি ফেলে নবীজি বললেন, 'হে মক্কা! খোদার কসম, তুমি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় শহর, আমার মাওলার কাছেও বেশি পছন্দের শহর তুমি। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত, আমি কখনও বের হতাম না।' (তিরমিজি : ৩৯২৫)। নবীজিকে দেশান্তরে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর একমাত্র আল্লাহর হুকুমে আদিষ্ট হয়েই তিনি মদিনার পথে হিজরত করেন। আর হিজরতের এই ঐশী হুকুম ও মহান ইবাদত পালনের মধ্য দিয়ে পদে পদে নেমে আসে আল্লাহর গায়েবি মদদ। আল্লাহর ভাষায়, 'আর যদি তোমরা তাঁকে সাহায্য না করো, তবে আল্লাহ তো তাঁকে সাহায্য করেছিলেন, যখন কাফেররা তাঁকে দেশান্তর করেছিল। তিনি ছিলেন দুইজনের দ্বিতীয়জন। যে সময় তাঁরা দুইজন ছিলেন গুহায়। যখন তিনি তাঁর স্বীয় সঙ্গীকে বলছিলেন, তুমি বিষণ্ন হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গেই আছেন। অতঃপর তাঁর উপর স্বীয় সাকিনা নাজিল করলেন এবং শক্তিশালী করলেন এমন সেনাদল দ্বারা, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আল্লাহ কাফেরদের কালামকে নিচু করে দিলেন আর আল্লাহর কালেমাই হলো সমুচ্চ। আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।' (সূরা তাওবা : ৪০)।
হিজরতের ফলে নবীজির প্রাপ্ত সুসংবাদ ছিল এরূপ- 'সুতরাং যারা হিজরত করেছে, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছে, আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে, জিহাদ করেছে এবং শহীদ হয়েছে। আমি অবশ্যই তাদের পাপগুলো মাফ করে দেব এবং তাদের এমন বাগানে প্রবেশ করাব, যার তলদেশে বইবে নহর। এ প্রতিদান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আল্লাহর কাছেই রয়েছে উত্তম প্রতিদান।' (সূরা আলে ইমরান : ১৯৫)। হাদিসে এসেছে, 'হিজরত তার পূর্ববর্তী সব পাপকে মিটিয়ে দেয়।' (মুসলিম : ১২১)।
হিজরত ফলাফলের দিক দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর সঙ্গে তুলনীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ওইসব ঘটনাবলির মহিমাকেও মস্নান করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক পি কে হিট্টি বলেন, 'হিজরত মক্কা যুুগের অবসান ঘটিয়ে এবং মদিনা যুগের সূত্রপাত করে মহানবী (সা.) এর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।' হিজরত শুধু মহানবী (সা.) এর জীবনের পরিবর্তন আনেনি, ইসলামের ইতিহাসেও এটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক জোসেফ হেলার (১৯২৩-১৯৯৯) বলেন, 'হিজরত' ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ টার্নিং পয়েন্ট।
হিজরতের মতো ঘটনা সংঘটিত না হলে ইসলাম মক্কার পৌত্তলিকদের মধ্যে স্বল্প পরিচিত একটি ধর্ম হিসেবে হয়তো সীমাবদ্ধ থাকত। মহানবী (সা.) মদিনায় আগমনের পর থেকে ইসলাম দিন দিন শক্তি লাভ করতে লাগল। অধিকাংশ মদিনাবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এর ভিত্তি দৃঢ় করেছিলেন। পরে ইসলাম যে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল তা হিজরতের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। ইসলাম তথা বিশ্বের ইতিহাসে হিজরতের প্রত্যক্ষ ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী। মদিনায় ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থারও ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও নীতি মক্কায় অবতীর্ণ হলেও এটা মদিনায় হিজরত করার পর একটি সংগঠিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরত মহানবী (সা.) কার্য পদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনেছিল। তাই বলা হয়, মহানবী (সা.) মক্কায় নবী ও রাসুল ছিলেন, পক্ষান্তরে মদিনায় তিনি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
হিজরতের পর মদিনাকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। ফলে মদিনার গুরুত্ব দেশ-বিদেশে বৃদ্ধি পায়, তেমনি বিভিন্ন গোত্র নিজেদের স্বার্থ ভুলে গিয়ে ইসলামের খাতিরে এক জাতিতে পরিণত হয়। সবাই ভাই ভাই- এ ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি বৃহৎ মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল, যার কাছে পরবর্তী সময়ে পরাক্রমশালী রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। হিজরত মহানবী (সা.) এবং নবদীক্ষিত মুসলমানদের জন্য এক চির কল্যাণকর দিক। নবদীক্ষিত মুসলমানরা যদি প্রথমে আবিসিনিয়ায় এবং পরে মদিনায় স্থায়ীভাবে হিজরত না করত তাহলে তাদের জীবন, জান, মাল হুমকির মধ্যে পড়ত, হয়তো বা জীবন নিঃশেষ হয়ে যেত। ইসলাম এত সহজে বিস্তার লাভ করত না। রাসুল (সা.) এর ইসলামী রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা গঠন করা খুবই কষ্টকর হতো। তাই আল্লাহর অশেষ রহমতে হিজরত হওয়ার ফলে মহানবী (সা.) ইসলামকে মদিনায় ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং শক্তি সঞ্চয় করে নিজ মাতৃভূমি মক্কাকে জয় করে বিজয়ীর বেশে রক্তপাতহীনভাবে ফিরতে পেরেছিলেন।

হিজরতের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়েছে। হিজরতের মাধ্যমেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিল। প্রকাশ্যে আজান, নামাজ, ঈদ সব কিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। হিজরতের বছরই মসজিদে নববি নির্মিত হয়, যা মূলত ইসলাম প্রচার ও প্রসারের কেন্দ্র বা মারকাজ হিসেবে বিবেচিত। সর্বোপরি হিজরত ইসলামের ইতিহাসে স্বতন্ত্র একটি মাইলফলক। তাই সাহাবায়ে কেরাম হিজরতের বছর থেকেই ইসলামী সালের গণনা শুরু করার সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছেন। ঐতিহাসিক এ সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর। দ্বীনে মুহাম্মাদির সব ধরনের বিজয়, প্রচার ও প্রসারের উৎসমূল ছিল এই ঐতিহাসিক হিজরত। কালক্রমে সেগুলো বিকশিত হয়েছে মাত্র। তাই হিজরত থেকেই শুরু হয় হিজরি সনের গণনা।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট